২০১৮ সালে উগান্ডা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের আফ্রিকা নীতি ঘোষণা করলেও আবহমানকাল থেকেই ভারত আফ্রিকার পাশে থেকেছে।

আফ্রিকান রাষ্ট্র গুলোতে কয়েক দশক পূর্বেও সামরিক অভ্যুত্থান খুবই নিয়মিত বিষয় হলেও, বর্তমানে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং কয়েকটি আঞ্চলিক সংস্থার একান্ত প্রচেষ্টায় সে মাত্রা অনেক কমে এসেছে। কয়েকটি রাষ্ট্রে শুরু থেকেই ব্যতিক্রম পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলেও, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কখনোই সেখানে মসৃণ ছিলো না।

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিকভাবেই বন্ধুর পথ পরিক্রমার পার করে আসা আফ্রিকানদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে মহামারী করোনা। ভ্যাকসিন সহ স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য নানা প্রতিবন্ধকতায় সেখানে পরিস্থিতি দিনকে দিন শুধু অবনতির দিকেই গিয়েছে। কিছুদিন পূর্বেই দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি রামাফোসা বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বৈষম্যকে ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সম্প্রতি জি-৭ দেশ গুলো প্রায় এক বিলিয়ন ডোজ করোনার টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ঘোষণাটি অনেক দেরীতে এসেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের মেধাস্বত্ত্ব সাময়িকভাবে বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে, যেনো আর্ত-পীড়িত মানুষেরা সহজে ভ্যাকসিন লাভ করতে পারে। এখানে না বললেই নয়, ভারতের ভ্যাকসিন মৈত্রী কূটনীতিটিও বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত এবং কার্যকর হয়েছিলো।

ভারত এবং আফ্রিকা এভাবে সবসময়ই একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে পাশে থেকেছে। ২০১৮ সালে উগান্ডা সফরের প্রাক্বালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের আফ্রিকা নীতি ঘোষণা করলেও আবহমানকাল থেকেই ভারত আফ্রিকার পাশে ছিলো, রয়েছে এবং থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী দশটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে আফ্রিকার প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা রচনা করেছিলেন। যথা: কূটনৈতিক আঙ্গিকে আফ্রিকাকে শীর্ষস্থানীয় অগ্রাধিকার দেয়া, উন্নয়নে অংশীদারিত্ব, আফ্রিকান পণ্যগুলোকে ভারতীয় বাজারে অগ্রাধিকার, আফ্রিকায় ডিজিটাল বিপ্লব বাস্তবায়ন, আফ্রিকায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নতিতে ভূমিকা রাখা, জলবায়ু পরিবর্তনে একত্রে লড়াই করা, সমুদ্র সুরক্ষায় একত্রে কাজ করা, আফ্রিকান তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চায়নে ভূমিকা রাখা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফ্রিকান অঞ্চলে চীনের আধিপত্যও চোখে পড়ার মতো। তাঁরা আফ্রিকায় রেলওয়ে নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরী, বন্দর স্থাপন, কৃষিতে উন্নতিকল্পে কাজ করার মাধ্যমে মহাদেশটিতে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে। বছরের প্রথম দিকেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পার্ষদগণ আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো সফরে যায়। তাছাড়া, ২০১৮ এর সেপ্টেম্বর মাসে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশন সামিটে প্রায় ৫৩ জন আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নিয়েছিলেন।

আফ্রিকাতে যদিও ২০০০ সাল থেকেই চীন ‘ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশন’ পরিচালনা করছে, তথাপি এর পাশাপাশি চীন-কেনিয়া শিল্প সহায়তা চুক্তির মতো অন্যান্য সম্পর্কও আফ্রিকাতে তাঁরা চালু রেখেছে। চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মধ্যেও আফ্রিকা একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

চীন আফ্রিকাতে নিজেদের উন্নয়ন মডেল পরিচিত করাতে চাচ্ছে, তবে ইতোপূর্বে ভারত, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং আমেরিকার মতো রাষ্ট্র গুলো চীনের ফাঁদে ফেলা কূটনীতির জন্য তাঁদের অভিযুক্ত করেছে। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে, উন্নয়নের টোপ দিয়ে পরবর্তীতে শোষণমূলক নীতি বাস্তবায়নে চীনের জুড়ি মেলা ভার। তাই অনেক আফ্রিকান রাষ্ট্র চীন থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট।

এদিকে, আফ্রিকাতে চীন এবং রাশিয়াকে টেক্কা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের আফ্রিকান নীতিতে পরিবর্তন আনছে। আবার ভারতও নিজেদের দুর্বলতাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠার মাধ্যমে আফ্রিকাতে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

এটি আফ্রিকায় ভারতের স্বদিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনোমিক কো-অপারেশন শুরু থেকেই পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মাধ্যমে আফ্রিকাতে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাই এতবছর পরও আফ্রিকান রাষ্ট্রনায়কগণ ভারতীয়দের সঙ্গেই স্বচ্ছন্দ্য।

পরিসংখ্যানের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, আফ্রিকা মহাদেশের এমন কিছু রাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তা ভারতে তাঁদের কর্মজীবনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যারা পরবর্তীতে তাঁদের রাষ্ট্রসমূহতে সেনা প্রধান বা সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানগন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীরতর করতে সচেষ্ট হোন এবং সম্পর্ক এগিয়েও নেন। সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৬ জন বর্তমান বা প্রাক্তন সেনাপ্রধান এবং প্রায় ১৩ জন বর্তমান বা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা উপ-রাষ্ট্রপতি ভারতে প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে সময় কাটিয়েছিলেন।

২০০৮ সাল থেকে ভারতও নিজেদের ইন্ডিয়া-আফ্রিকা ফোরাম সামিট তৈরী করে এবং বিগত বছরগুলোয় আফ্রিকার উন্নয়নে বিশাল পরিমাণ অঙ্ক সহায়তা প্রদান করে। বর্তমানে আফ্রিকার প্রায় ৪০ টিরও বেশি দেশে একদমই স্বল্প সুদে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে ভারত।

ভারত আফ্রিকা সম্পর্কের আরও একটি বিশেষ দিক হলো, বিগত সময় গুলোতে প্রায় ২ মিলিয়নেরও বেশি ভারতীয় আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহে পাড়ি জমিয়েছেন। তেমনইভাবে প্রতিবছরই আফ্রিকান অনেক ছাত্র, জনগণ সমানহারে ভারতে আসেন কর্মসূত্রে কিংবা স্বাস্থ্য বা শিক্ষা ক্ষেত্রে অংশ নেয়ার জন্য। এটি অঞ্চল দুটোর মধ্যে একটা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে।

এমনকি করোনা সঙ্কটেও প্রায় ৪২ টিরও বেশি আফ্রিকান রাষ্ট্রে ভারত ভ্যাক্সিন কিংবা প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী পাঠিয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর প্রথম ভরসা হিসেবে ভারত পাশে ছিলো এবং থাকবেও। বর্তমানেও ভারতের তত্ত্বাবধানে আফ্রিকাতে প্রায় ১৮৯ টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র ই-শিক্ষা এবং ই-স্বাস্থ্য প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে ভারত এবং সেগুলো আফ্রিকান তরুণদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে।

গত মাসেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে আফ্রিকানদের পক্ষাবলম্বন করে বক্তব্য রাখেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেখানে আফ্রিকানদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার উপর জোর দেন ভারতীয় মন্ত্রী।

সবকিছুর পাশাপাশি, ভারতীয়দের সম্পর্কে আফ্রিকানদের ধারণাও বেশ উঁচু। সার্বিকভাবে সকল কাজের অংশীদার হিসেবে ভারতীয়দের তাঁরা বিশ্বাস এবং ভরসাও যেমন করেন, ভারতীয়দের সম্মানও করেন তাঁরা।

যেহেতু ভারতের সাথে আফ্রিকার অংশীদারিত্ব বৃহত্তর পরিসরে বাড়ছে এবং ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুরক্ষা বিধানে আফ্রিকাকে পাশে চাইছে, তাই আফ্রিকা এবং ভারত একত্রে আরও অনেকদূর এগোবে বলে ধারণা করি। আফ্রিকার টেকসই উন্নয়ন এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় একত্রে কাজ করছে ভারত এবং আফ্রিকা।

আর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স একত্রে আফ্রিকাতে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে ভারতও এই বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে উঠবে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় বলাই যায়, আফ্রিকার যেকোনো সঙ্কট কিংবা প্রয়োজনে ভারত সর্বদাই ভূমিকা রেখে এসেছে এবং বর্তমানের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও তা বজায় রাখবে। পারস্পরিক স্বার্থ এবং লক্ষ্য অর্জনে হাতে হাত ধরে এগোবে আফ্রিকা এবং ভারত।

লেখক: লিবিয়া, জর্ডান এবং মাল্টায় দায়িত্ব পালন করা প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। বর্তমানে স্বামী বিবেকানন্দ আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের একজন সম্মানিত ফেলো। (প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণই লেখকের নিজস্ব অভিমত)