ভারতে জাতিগত, শ্রেণীগত, সংস্কৃতিগত এবং ধর্মের ভিত্তিতে ব্যাপক বৈচিত্র থাকলেও এখানে গণতন্ত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল।

সম্প্রতি হংকং ভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট (এসসিএমপি) ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত ০৭ আগস্ট প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে ‘টু কিল এ ডেমোক্রেসি: ইন্ডিয়া’স প্যাসেজ টু ডেপোটিজম’ শীর্ষক একটি বইয়ের বিভিন্ন উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়, যার বেশিরভাগই উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ভারতের ভাবমূর্তির জন্যে নেতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।


বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলা হয় ভারতকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভারতীয়দের অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সম্প্রতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী এবং জন কিইন এর যৌথভাবে লেখা ‘টু কিল এ ডেমোক্রেসি: ইন্ডিয়া’স প্যাসেজ টু ডেপোটিজম’ -শীর্ষক বইয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের নানান অসামঞ্জস্যতার কথা তুলে ধরা হয়। সর্বোপরি, বইটিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যও জুড়ে দেয়া হয়।



দুই লেখকের মতে, ভারত গণতন্ত্রের প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের সমস্যা গুলোকে দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল বলেও আখ্যা দেন তাঁরা। কিন্তু আদতে বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে জাতিগত, শ্রেণীগত, সংস্কৃতিগত এবং ধর্মের ভিত্তিতে বিশাল বৈচিত্র্য থাকলেও গণতান্ত্রিক পন্থায় ভারত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল। বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সমাজধারায় বৈচিত্র্যের কারণে অনেক সময়ই এখানে মতবিভেদের সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু সর্বোপরি ভারতীয় গণতন্ত্র এখনও নিজ দেশের মানুষদেরকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্যে এবং স্বীয় মতামত প্রদানের জন্যে প্রচুর সুযোগও তৈরী করে দেয়।



এতদ্বসত্ত্বেও, এসসিএমপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভারতকে নিচু দেখানোর লক্ষ্যে নেতিবাচক মন্তব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাঁরা উপরোক্ত বইটির কিছু অংশ ব্যবহার করে লিখছে, ভারত শীঘ্রই হাঙ্গেরী, কাজাখস্থান কিংবা তুরস্কের তালিকায় যুক্ত হবে, যারা গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারের দিকে ধাবিত হয়েছে।



অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বইটির উভয় লেখকেরই নেহায়েত একটি পক্ষপাতমূলক মানসিকতা রয়েছে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতা বিবর্জিত। ধারণা করি, ভারতের জনগণ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক যুক্তিতে ভরপুর তাঁদের মতাদর্শ। নাহলে, ভারতের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় যে এর প্রাণবন্ত নির্বাচনী পদ্ধতি, সে কথা কীভাবে ভুলে গেলেন তাঁরা? সংবিধান প্রণয়ন এবং গৃহীত হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় প্রজাতন্ত্র প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বিক ভোটাধিকার নিশ্চিত করে আসছে।



সর্বোপরি লেখকদ্বয় ভারতের স্বৈরশাসন পদ্ধতিকেই সংজ্ঞায়িত করেছেন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। কর্পোরেট নেতৃত্ব, সরকারপন্থী সংবাদ সংস্থা, অনুগত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাহরণ তুলে ধরে তাঁরা সরকারকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করছে। কিন্তু তাঁরা বেমালুম ভুলে গেলেন যে জনগণের মেন্ডেট নিয়েই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাঁরা বেমালুম ভুলে গেলেন যে জনগণের সিংহভাগের সমর্থন এই সরকারের প্রতি রয়েছে!



নিঃসন্দেহে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের মতো বিষয়গুলো লেখকদ্বয় নিজেদের বইয়ে তলে ধরেননি। ভারতের সংবিধান অনুসারে প্রতিটি রাজ্যেরই নিজস্ব ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা এবং দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে। এটি এ দেশের সমাজের সার্বিক ভারসাম্য বিধান করে। ভারতে বর্তমানে সর্বত্র জনগণের মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটানো সরকার বিরাজমান। এটি ভারতের উন্নত গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের পরিচায়ক।



বইটিতে ভারতের গণতন্ত্রের পতনকে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব নিয়েও। তাঁরা মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদী যুগে ভারতীয় গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা এটি ভুলে গিয়েছেন যে সারাদেশ জুড়ে অসংখ্য মিডিয়া রয়েছে যারা প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত তীব্র বাক্যবাণ ছুড়ে দিচ্ছেন। সরকারের বিরোধীতা করার কোনো সুযোগই তাঁরা ছাড়ছেন না।



দেশে এখনও অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদ রয়েছেন যারা প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তাঁদের মধ্যে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে অসংলগ্ন এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে কারাগারে নেয়া হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই এখনও অবধি মুক্ত পৃথিবীতে মুক্তমত প্রদান করে চলেছেন। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেও সবসময় বলে এসেছেন তাঁর মতাদর্শের কথা। তিনি সবসময়ই বলেছেন, “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” (সবার সাথে, সবার উন্নতি) । তারপরও কীভাবে গণতন্ত্রের হত্যা হচ্ছে, সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়াই যায়।



সারা বিশ্ব জুড়েই নাগরিকদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের মানদণ্ড পূরণ হয়। তাঁদের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। তাঁদের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে। ভারতে এই ব্যাপারটির যে সর্বোচ্চ প্রয়োগ হচ্ছে, সে বিষয়টি হয়তো লেখকদ্বয় বইটি লিখতে গিয়ে ভুলে বসেছেন। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে মোদী বিরোধীরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসে আছেন, সে কে না জানে?



রাসেল ডাল্টন, দোহ শিন এবং উইলি জো এর মতো প্রথিতযশা লেখকগণ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “এর বিভিন্ন সম্ভাব্য অর্থ রয়েছে। গণতন্ত্র উপলব্ধি বা সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। এমনকি শিল্প ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র, গবেষণা প্রায়ই সীমিত রাজনৈতিক জ্ঞান এবং জনসাধারণের অপরিণতিবোধকে পিছু ফেলে দেয়। অনেকের কাছে গণতন্ত্র বিতরণযোগ্য বস্তু। কারও কাছে গণতন্ত্রের অর্থ হতে পারে 'রাম রাজ্য' এবং কারুর জন্য এর অর্থ হতে পারে সরকার থেকে গ্রামে এবং বাড়িতে বিদ্যুৎ পাওয়া।”



দেবাশীষ রায় চৌধুরী এবং জন কিইন রচিত বইটিতে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা, স্বাধীন বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশ এবং চলাচলের মতো অধিকার গুলো নিয়মিতভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ছে ভারতে। কিন্তু আদতে দিনকে দিন ভারতের একতা ও অখন্ডতার বিষয়টি জনগণ আরও বেশি করে আত্মস্থ করছে। এটাই বর্তমান বাস্তবতা।



সবশেষে এটুকুই বলবো, বইটি প্রকাশের আগে ভারত সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জেনে এবং গবেষণা করলে লেখকদ্বয় আরও নিরপেক্ষভাবে বিষয়গুলো প্রকাশ করতে পারতেন। সে সঙ্গে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এরও উচিৎ এটা ভালোভাবে বুঝে নেয়া যে, সাংবাদিকতার কিছু ন্যূনতম এথিকস থাকা উচিৎ। যেকোনো পরিস্থিতিতে কান্ডজ্ঞানহীনের মতো কিছু একটা প্রকাশ করে দিয়ে একটা গোটা রাষ্ট্র ও তাঁর জনগণকে আঘাত দেয়া মোটেও কাম্য নয়।



লেখক: দিল্লীভিত্তিক সিনিয়র সাংবাদিক, প্রকাশিত লেখনী তাঁর নিজস্ব অভিমত।