মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করায় স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং ইরান।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর থেকেই পাকিস্তানের গোপন এবং প্রত্যক্ষ সমর্থনে ভূখন্ডটি থেকে আশরাফ ঘানির সরকারকে সরিয়ে পুনরায় ক্ষমতা দখলে নেয়ার লড়াইয়ে মেতে উঠে আফগান তালেবান। অবশেষে প্রায় বিনা বাঁধায় কাবুল দখলে সক্ষমও হয়েছে তাঁরা। ফলস্বরূপ গোটা অঞ্চল জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক খেলার।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে নাটকীয় যুদ্ধের সূচনা করে, তার শেষটাও নাটকীয় হয়েই থাকলো। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধে খালি হাতেই ফিরতে হলো মার্কিনীদের। প্রায় ২০ বছর আফগান ভূখন্ডে অবস্থানকালে যুদ্ধের ব্যয় স্বরূপ প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচের পাশাপাশি দেশটিতে তিন লাখ মার্কিন সৈন্যও মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধে প্রায় ২৪০০ মার্কিন সেনা প্রাণ হারান। কিন্তু যুদ্ধের কোনো চূড়ান্ত ফলাফল ছাড়া আকস্মিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ত্যাগ করায় বর্তমানে আফগান ভূখন্ড ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই আফগানিস্তানে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে চীন এবং রাশিয়া। বুঝতে অসুবিধা নেই, ইতোমধ্যে বেইজিং এর সমর্থন লাভ করেছে তালেবান। কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই দেশটি সফর করেন তালেবান নেতৃত্ব। অন্যদিকে, রাশিয়াও তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ইতিবাচক। তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার বৈঠকে রুশ প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান আলোচক জমির কাবুলভ ইতোপূর্বে কয়েকবারই তালেবানের সঙ্গে মিত্রতার পক্ষে সাফাই দিয়েছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আফগানিস্তানের তালেবান উত্থানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে বিগত বিশ বছরে আফগানিস্তানের ভূখন্ডে হওয়া সামাজিক উন্নয়ন। নারী সমতা ও অধিকার দুটোই নিঃসন্দেহে হুমকির সম্মুখীন। পুরুষেরাও কী খুব সানন্দে জীবন চালাতে পারবেন? প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, না। আফগানিস্তানের ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান শাসনামলকে খোদ আফগান অধিবাসীরাই অন্ধকারে যুগ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

মার্কিন সৈন্যরা আফগান সাধারণ জনগণকে যে পরিস্থিতিতে ফেলে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন, তা গোটা বিশ্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, প্রতিপত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতায় ফাটল ধরাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করায় স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং ইরান।

খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ গোটা বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সেটি নিশ্চিতও করেছেন তিনি।

বাইডেন বলেছেন, “আফগানিস্তানের বোঝা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিরদিন বয়ে নিতে পারেনা!” এটি সত্য যে খোদ মার্কিন জনগণও চায়না আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা দিনের পর দিন পড়ে থাকুন। কিন্তু আফগান সাধারণ জনগণকে এভাবে অভিভাবকহীন অবস্থায় ফেলে এসে নিজ দল এবং বিরোধী দলের সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি।

বাইডেন ইচ্ছে করলেই আফগান সেনা প্রত্যাহারে বছর খানেক বিলম্ব করতে পারতেন। তিনি চাইলেই একটি স্থিতিশীল আফগান ভূখন্ড প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ ছিলো। তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় শর্ত জুড়ে দেয়ার সুযোগও তাঁর সামনে ছিলো। কিন্তু তিনি তা করেননি। উলটো তিনি দোষ চাপাচ্ছেন আফগান সরকারী বাহিনীর উপর। বাইডেন বলেছেন, “আমরা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্ভব সবকিছু করেছি। কিন্তু আফগান সরকারী বাহিনীই চান না উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যুদ্ধ করতে। তাই অস্ত্র, অর্থ সহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পাবার পরও এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।”

অন্যদিকে তালেবানের প্রতিরোধ না করে আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফ ঘানি মাঝরাতে যেভাবে কাপুরুষের মতো নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, সে বিষয়ে নাহয় কথা নাই-বা বললাম।

আফগানিস্তানে বর্তমান পরিস্থিতি:

গত ১৫ আগস্ট, রবিবার, কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা ছাড়াই রক্তপাতহীনভাবে কাবুলের প্রেসিডেন্ট ভবন দখলে নিয়েছে তালেবান। এখনও গোটা দেশের সকল স্থান দখলে না নিতে পারলেও, অচিরেই তা তালেবান নিয়ন্ত্রণে যাবে, তা চোখ বুজেও বলে দেয়া যায়।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে দেশটির দখল নিয়েছে তালেবান জঙ্গীরা। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এতো দ্রুত তালেবান উত্থান কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সপ্তাহেও বলেছিলেন, আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ দখল নিতে তালেবানের আরও কয়েক মাস লাগবে। সে অবধি আফগান সরকারের সুসজ্জিত বাহিনী তালেবান প্রতিরোধে সক্ষম হবে। কিন্তু সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে তাঁর সে কথা মিথ্যা প্রমাণ করে দেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।

তালেবান কী পাল্টেছে?:

তালেবানের মিত্র হিসেবে ইতোমধ্যে ভূ-রাজনীতিতে অবতীর্ণ হওয়া পাকিস্তান এবং রাশিয়া প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে যে, বিগত ২০ বছরে জঙ্গী গোষ্ঠীটির চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাঁদের ভাষ্যমতে, বিগত এই বছরগুলোতে তালেবান অনেক বেশি মানবিক হয়েছে এবং তাঁদের পূর্বের শাসনাকালে ঘটে যাওয়া অমানবিক সকল কাজের পুনরাবৃত্তি যেনো না হয়, সেদিকে মনযোগী থাকবে।

তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে না তালেবানের এতো ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া সম্ভব! ইতোমধ্যে গোষ্ঠীটি গোটা আফগান জুড়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বিগত কিছুদিনের ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি, তালেবান কর্তৃক দখলকৃত প্রদেশ গুলোতে ইতোমধ্যে মেয়েদের বাইরে বেরুনোর উপর, কর্মক্ষেত্রে যাবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা। একই সঙ্গে পুরুষদের ক্ষেত্রেও দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে দলটি। ১৫ বছরের কম বয়সী যুবতী এবং ৪৫ বছরের কম বয়সী বিধবাদের তালিকা চেয়ে ইতোমধ্যে সকল অঞ্চলে ফরমান জারি করেছে জঙ্গী সংগঠনটি।

ধারণা করি, আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক দিকে মাস কয়েক পাকিস্তানের আইএসআই রাওয়ালপিন্ডি জিএইচকিউ -এর নির্দেশনা মোতাবেক তালিবানরা নিজেদের চরমপন্থী রূপ প্রকাশ্যে আনবেনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রকাশ পাবে নিশ্চিত।

ভারতের করণীয়:

একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিক সার্বভৌম আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ইচ্ছের কথা সবসময়ই জানিয়ে এসেছে ভারত সরকার। তবে অবস্থাদৃষ্টে কাবুলে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বর্তমানে ক্ষীণ।

ভারত চায় না কাবুলের সরকার পুরোপুরি পাকিস্তানের প্রভাবাধীন থাকুক। একই সঙ্গে আফগানিস্তানের ভূখন্ড ভারত বিরোধী সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহৃত হোক, স্বাভাবিকভাবে এটিও চাইবেনা নয়াদিল্লী।

এখনও অবধি তালেবানের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌছায়নি ভারত। পাশাপাশি তালেবানকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবেই সবসময় দেখে এসেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান এবং তুরস্ক সহ এই অঞ্চলের এবং এর বাইরের অন্যান্য দেশগুলো স্বীয় স্বার্থ রক্ষা ও সুরক্ষার জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা এজেন্সির মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছে।

এটি স্পষ্ট যে তালেবান ক্ষমতা দখলে নিলেও খুব শীঘ্রই বৈশ্বিক সমর্থন এবং দেশ পরিচালনার জন্যে অর্থের যোগান ও ব্যবসা বাণিজ্যের বন্দোবস্তও করার প্রয়োজন পড়বে তাঁদের। এক্ষেত্রে ভারত তালেবানের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হবে। তাদেরকে বাণিজ্যিক এবং বৈশ্বিক দুভাবেই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতে পারে একমাত্র ভারত।

তাই ভারতের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে তালেবান নেতৃত্ব আগ্রহী বলেই প্রতীয়মান হয়। তালেবান ঘোষণা দিয়েছে কাশ্মীর ইস্যুতে তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নিবেনা এবং এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই মান্যতা দিবে। পাশাপাশি আফগানিস্তান জুড়ে ভারত কর্তৃক পরিচালিত বিশাল পরিমাণ উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রশংসা সূচক বক্তব্য দিয়েছে তাঁরা।

এদিকে, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকে যাবতীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। একই সঙ্গে, আফগানিস্তান জুড়ে সার্বিক মানবাধিকার রক্ষার ডাক দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তালেবানের প্রতিও একই আহবান জানিয়েছে ভারত।

তবে সব কথার এক কথা, তালেবানকে সামনে রেখে হলেও দিল্লীকে এখনই ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে। স্বীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে দিল্লীকে। বৈচিত্র্যময় টানাপোড়েনের এই খেলায় ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ গুরুদায়িত্ব দিল্লীর হাতেই ন্যস্ত।

লেখক: একজন প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক। গ্লোবাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি। প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব মতামত।