কেবলমাত্র সাড়ে চৌদ্দ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে ১৩৬ কোটি জনসংখ্যার ভারতবাসীর মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়।

সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর একটি ছোট জনমত জরিপ পরিচালনা করে বিবিসি। অতঃপর ‘মহামারী এবং মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি মোদীর উপর আঘাত স্বরূপ’ -নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে তাঁরা। গোটা নিবন্ধে গত জুলাই মাসে প্রকাশ হওয়া ইন্ডিয়া টুডের ‘মুড অব দ্যা নেশন’ এর আলোকে বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে, যেটা আদতে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিচু দেখানোর একটি অপপ্রয়াস মাত্র।

এছাড়াও, নিবন্ধটিতে কিছু শুভঙ্করের ফাঁকি-ও দেয়া হয়েছে। নিবন্ধে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে যে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে মাত্র ২৪% উত্তরদাতা মোদীকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইছেন। কিন্তু এটি উল্লেখ করা হয়নি যে, মোদীর সঙ্গে তুলনায় অন্য সকল নেতা এই পরিমাণ সমর্থনও পাননি। অর্থাৎ মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে খ্যাত সকল রাজনীতিক ২৪% এরও কম ভোট পেয়েছেন। আলোচনার সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো, এই তালিকায় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে বেছে নিয়েছেন ১১% মানুষ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বেছে নিয়েছেন মাত্র ৭% মানুষ।

জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের প্রায় ১৬% মোদীর সময়কালে ভারতের অর্জনকে ‘অসামান্য’ বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়াও, ৩৮% অংশগ্রহণকারী মোদীর পার্ফর্ম্যান্সকে ‘ভালো’, ৩০% উত্তরদাতা এই সময়কালকে ‘গড়পড়তা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে, মাত্র ১১ শতাংশ উত্তরদাতা মোদীর সময়কালকে খারাপ এবং ৫% উত্তরদাতা এই সময়কালকে খুব খারাপ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। এই দিকটি বিবিসি সুনিপুন ভাবে প্রচারণার সময় এড়িয়ে গিয়েছে।

শুধু বর্তমান সময়ের কথা বাদই দিলাম। ভারতের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী কে? জরিপ পরিচালনাকালে খোদ বিবিসির করা এই প্রশ্নের উত্তরে ২৭% নাগরিক প্রধানমন্ত্রী মোদীর নাম নিয়েছেন। অপরদিকে, ১৯% উত্তরদাতা অটল বিহারী বাজপেয়ীর নাম, ১৪% মানুষ ইন্দিরা গান্ধী, ১১% মনমোহন সিং, ৮% জওহর লাল নেহরু, ৭% রাজীব গান্ধী, ৬% লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ৩% নরসিমহা রাও, এবং ২% যৌথভাবে ভিপি সিং ও মোরারাজী দেশাই এর নাম নিয়েছেন।

অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে ভারতের একটি বড় অংশ প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ভারতের ইতিহাসের সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মান্যতা দিচ্ছেন। নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, বাজপেয়ীদের মতো জনপ্রিয় নেতাদেরও পেছনে ফেলছেন মোদী। কিন্তু আফসোসের বিষয়, নিবন্ধ প্রকাশের সময় বিষয়টি সুচতুর ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে বিবিসি। সেখানে এর উল্লেখমাত্র করা হয়নি।

বিবিসির নিবন্ধটিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বিজেপি হেরেছে, কথাটি ফলাও ভাবে প্রচার করা হলেও, এটি বলা হয়নি যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ভোট বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। বিগত ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যেখানে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পাবার মাধ্যমে ৩ টি আসন দখল করতে পেরেছিলো, সেখানে এবারের নির্বাচনে প্রায় ৩৮% ভোট লাভ করার পাশাপাশি ৭৭ টি আসনও দখল করতে সক্ষম হয়। বিজেপির এমন উল্লম্ফনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বাম এবং কংগ্রেস জোট। অথচ এটি বিবিসি নিবন্ধে একবারও উল্লেখ করা হয়নি।

নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, মোদী বিভাজনের রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছেন। অথচ তিনি ভুলে গেলেন প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ষাট কোটিরও বেশি মানুষের জনসমর্থন নিয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছেন মোদী। তিনি কী বলতে চাইছেন ভারতের ষাট কোটিরও বেশি মানুষ সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে? এ কথা পাগলও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতে চাইবেনা। আসল কথা এই যে, মোদী ক্ষমতায় এসেছেন দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটিয়ে, জাতীয় নিরাপত্তার উন্নতি ঘটিয়ে এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ব্যাপক অভিযানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

যদি মোদী একজন মেরুকরণকারী রাজনীতিকই হয়ে থাকেন, তাহলে প্রত্যেক নির্বাচনের পুর্বেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যে মন্দির পরিদর্শন করে প্রচারণা শুরু করেন, সে বিষয়টিকে কী বলা যায়? অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোকেই বা কী বলবেন যারা বিধানসভা নির্বাচন এলেই ভারতীয় সত্ত্বা ভুলে প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদের দোহাই দেয়া আরম্ভ করে?

তাই সহজভাবে বলতে চাই, নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হতে এখনও অনেক সময় বাকি রয়েছে। কেবলমাত্র সাড়ে চৌদ্দ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে ১৩৬ কোটি জনসংখ্যার ভারতবাসীর মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়। আর প্রকৃত সত্য প্রকাশ না করে, প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করে, বিবিসি প্রতিনিয়ত যে ভারত বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সবাইকে এখনই সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখকঃ দিল্লীভিত্তিক সাংবাদিক, প্রকাশিত মতামত একান্তই তাঁর নিজস্ব