ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত সর্বদা নিজেদের প্রতিবেশীকে প্রথমে স্থান দেয়। পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি ভারতের এই নীতি বিস্তৃত।

বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণে ভারতের বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানিয়ে নিতে ব্যাপক সাহায্য করে বলে অভিমত দিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব শ্রী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত সর্বদা নিজেদের প্রতিবেশীকে প্রথমে স্থান দেয়। পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি ভারতের এই নীতি বিস্তৃত।



২০ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ৬ষ্ঠ জেপি মরগান ‘ইন্ডিয়া ইনভেস্টর’ সম্মেলনে “ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং এর কৌশলগত বাধ্যবাধকতা” সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা। এসময়, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন তিনি।



তিনি জানান, “সড়ক, রেল, আভ্যন্তরীণ নৌ রুট এবং মাল্টি মোডাল সংযোগের মাধ্যমে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহের সঙ্গে আমরা ব্যাপক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট এবং বদ্ধপরিকর।” এসময় বাংলাদেশে রেলওয়ে সেতু ও সঙ্কেত ব্যবস্থা নির্মাণ, নেপালের সঙ্গে রেল প্রকল্পে অগ্রগতি, শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধ পরবর্তী রেলপথ পুনর্গঠন, ইরানে চাবাহার ও মায়ানমারে সিটওয়ে বন্দর নির্মাণ এর মতো প্রকল্প গুলো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।



তিনি বলেন, “এই প্রকল্প গুলো ভারতের সঙ্গে অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তের করিডোর হিসেবে কাজ করছে। দ্রুত পণ্য এবং লোকজন পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা আমাদের আভ্যন্তরীণ উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।”



হাইড্রোকার্বন পাইপলাইন ভারত এবং নেপালকে সংযুক্ত করছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব মন্তব্য করেন, “ভারতের এনার্জি গ্রিডগুলো বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল এবং মায়ানমারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ, ভূটান এবং নেপালের বিদ্যুৎ প্রকল্পে আমরা বিনিয়োগ করেছি। এতে আমাদের যেমন লাভ হচ্ছে, তারাও উন্নয়নের পথে ধাবিত হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে বলে আমি আশা প্রকাশ করছি।”



ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রিংলা বলেন, “ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অঞ্চলটিতে আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সচেষ্ট, পাশাপাশি নেট সুরক্ষা প্রদান সহ নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের প্রগতিশীল এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ভারত মহাসাগরীয় রিম এসোসিয়েশন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে আসছি।”



ভারত আশিয়ান ভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্বীয় নীতির প্রতিফলন করছে বলে অভিমত দেন তিনি। তিনি জানান, “আশিয়ান ইন্ডিয়া সামিট, পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে, আশিয়ান আঞ্চলিক ফোরাম, এএসইএম, এডিএমএম+, বিমসটেক এবং সম্প্রসারিত এশিয়ান মেরিটাইম ফোরামের মতো একাধিক প্ল্যাটফর্মে ভারত আশিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।”



এর পাশাপাশি ভারত স্বকীয়তা বজায় রেখে বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর সাথেও সম্পর্ক দৃঢ় করছে বলে সম্মেলনে মন্তব্য করেন শ্রিংলা। উদাহরণ স্বরূপ, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে স্বাক্ষরিত ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন চুক্তি এবং রাশিয়ার সঙ্গে মহাকাশ সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন তিনি।



অন্যদিকে, ডেনমার্কের সঙ্গে জলবায়ু বিষয়ক ডিজিটাল সহযোগিতা ও সংযোগ চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গেও ভারত ক্রমাগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে বলে অভিমত দেন শ্রিংলা। তাছাড়া পারস্য উপসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জ্বালানি এবং অভিবাসন বিষয়ক কার্যক্রমের গতি নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।



এসময় জাপানকে তিনি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার উল্লেখ করে বলেন, “তাঁরা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। দেশটি আমাদের আহমেদাবাদ এবং মুম্বাইয়ের দ্রুতগতির রেল স্থাপন সহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প তৈরীতে সহযোগিতা করেছে এবং বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।”



আফ্রিকা মহাদেশীয় অনেক শিক্ষার্থী ভারতে নিয়মিত পড়াশোনা করছে এবং ভারত আফ্রিকার উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে জানিয়ে সেখানকার দেশগুলোর সঙ্গেও ভারত ক্রমাগত সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে চলেছে মন্তব্য করেন শ্রিংলা।



বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরারও চেষ্টা করেছেন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, “আমরা বর্তমানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করছি। সে সঙ্গে সদ্য এসসিও-র সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা ব্রিকস এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। জি-২০ সম্মেলন আয়োজন সহ এবারের জি-৭ বৈঠকেও আমরা উপস্থিত থাকবো। তাছাড়া মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ভারত অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।”



ভারত তাঁর ‘সবার সঙ্গে সবার উন্নতি’ নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মন্তব্য করে শ্রিংলা বলেন, “অপারেশন সঞ্জীবনী এবং ভ্যাক্সিন মৈত্রীর মাধ্যমে ভারত আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের সক্ষমতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ১৫৪ টিরও বেশি দেশে ওষুধ এবং স্বাস্থ্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে ভারত বিশ্বের ফার্মেসী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”



নিজের প্রবাসী সন্তানদেরকেও সেবা দিতে ভারত বদ্ধপরিকর জানিয়ে শ্রিংলা বলেন, “সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের কোভিড সঙ্কটে সেবা দানের জন্য আমরা একটি ২৪*৭ সার্ভিস দেয়া কোভিড হেল্প সেল তৈরী করেছি। করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় -উভয় ধাপেই এটি বিশ্বব্যাপী ভারতীয়দের মেডিকেল সেবায় কাজ করে চলেছে। পাশাপাশি দ্বিতীয় ধাপে ভয়ানক পরিণতির প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যপী সাহায্যের জন্য জনমত গড়ে তোলা এবং সহায়তা সংগ্রহের জন্যেও আমরা একটি টীম গড়ে তুলেছি।



এসময় আসন্ন কোয়াড সম্মেলন নিয়েও কথা বলেন তিনি। শ্রিংলা জানান, “এবারের কোয়াড শীর্ষ নেতৃত্বের আলোচনায় সাম্প্রতিক বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার উপর জোর দেয়া হবে। পাশাপাশি মহামারী উত্তরণে ভ্যাকসিন সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক গঠনের বিষয়েও জোরদার আলোচনা করা হবে বৈঠকে। তাছাড়া, নিজেদের মধ্যকার উদীয়মান প্রযুক্তি ভাগ করে নেয়া, সংযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, সাইবার নিরাপত্তা, সমুদ্র নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা, দুর্যোগ ত্রাণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিক্ষার বিকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গুলো আলোচনায় স্থান পাবে।”



এর বাইরে, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে দ্রুত আলোচনা এগোচ্ছে বলে জানান তিনি।



চীনের উত্থান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতকে শীর্ষে আসীন করেছে বলেও মন্তব্য করেন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব শ্রী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নয়নে সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন অভিজ্ঞ এই কূটনীতিক। ভারত সরকারের তরফে চীনা কর্তৃপক্ষকেও এ কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।



পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “গত বছর লাদাখে চীনের এক তরফা আক্রমণ সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতাবস্থা স্থাপন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই কাজ আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সমূহের স্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বেও এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।” এসময় ভারত এবং চীনের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে তিনটি মানদন্ড তুলে ধরেন তিনি। শ্রিংলা বলেন, “পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সংবেদনশীলতা এবং পারস্পরিক স্বার্থ পারে প্রতিবেশী দু রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন করতে।”



আলোচনাকালে আফগানিস্তান ইস্যুতেও কথা বলেন শ্রিংলা। তিনি বলেন, “প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান নিয়ে আমরা উদ্বীগ্ন। আমরা আশঙ্কা করছি সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘরে পরিণত হতে পারে দেশটি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতিত্বকালে আমরা এ নিয়ে তিনবার অধিবেশন আহবান করেছিলাম। আমাদের উদ্যোগেই জাতিসংঘে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী রেজুলেশন ২৫৯৩ প্রণীত হয়েছে।”



একই সঙ্গে, আফগানিস্তানের উন্নয়নে গত দু দশকে ভারতের অবদান গুলো সবার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করেন শ্রিংলা। তিনি জানান, আফগানিস্তানের ৩৪ টি প্রদেশে প্রায় ৫০০ টিরও বেশি প্রকল্প ভারতীয় তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অসমাপ্ত রাখতে হচ্ছে।



নিজ বক্তব্যের মাঝে ভারতীয় কূটনীতির পাঁচটি স্তম্ভ বা মূল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে বলেও জানান শ্রিংলা। পরবর্তীতে সেসবের বিশদ ব্যাখ্যাও দেন তিনি। সর্বোপরি, বহুমাত্রিক ও বহুপাক্ষিক এসব দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে সমুন্নত রাখতে ব্যপক সহায়তা করে বলে মন্তব্য করেন তিনি।