কোয়াড নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, অন্য কোনো দেশকে অস্থিতিশীল করতে তথা সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্যে আফগান ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেয়া হবেনা।

প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বৈঠক করলেন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত জোট কোয়াড এর শীর্ষ নেতৃত্ব। গত ২৪ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনাকালে করোনা মহামারী পরবর্তী টেকসই বিশ্ব গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় লড়াই এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতন্ত্র স্থিতিশীল রাখার উপর জোর দিয়েছেন নেতারা।

তবে সব ছাপিয়ে শুক্রবার অনুষ্ঠিত কোয়াড বৈঠকটিতে কিছু বিষয় রীতিমতো আকৃষ্ট করেছে ভারতীয় কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের। বৈঠকের শুরু থেকে শেষ অবধি অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করা হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ককে জানায়, ইতোপূর্বে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে এতোটা সম্মানের অধিকারী হননি।

জানা গিয়েছে, বৈঠক কক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা মেনে সবার শেষে প্রবেশ করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একইভাবে বৈঠকের শেষে জ্যেষ্ঠতা অবলম্বন করে কক্ষ থেকে সবার প্রথমে বের হোন মোদী। তাছাড়া গোটা আলোচনা জুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য কিংবা রেফারেন্স প্রদানের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারংবার মোদীর পরামর্শ গুলো তুলে ধরছিলেন।

বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী মোদী মূলত প্রযুক্তি অংশীদারিত্ব, সাইবার সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আফগানিস্তান নিয়ে সরব হোন। কিন্তু দেখা যায়, পরবর্তীতে কোয়াড জোটের অন্য নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই নরেন্দ্র মোদীর পথ ধরেই বক্তব্য দেন এবং বারবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রেফারেন্স তুলে ধরছিলেন।

এসময় আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আফগানিস্তান ইস্যু এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় জোর দেন কোয়াড নেতৃত্ব। আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের ২৫৯৩ নং রেজুলেশন মেনে চলার আহবান জানান তাঁরা।

কোয়াড নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, অন্য কোনো দেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্যে আফগান ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেয়া হবেনা। পাশাপাশি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেনো ভূখন্ডটিতে আশ্রয় না নিতে পারে, অর্থায়ন না লাভ করে কিংবা প্রশিক্ষণ দান না করে, সেদিকেও জোর দেন তাঁরা। এসময়, আফগান জনগণের প্রতি নিজেদের পূর্ব সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন কোয়াড নেতৃত্ব।

এছাড়াও, সন্ত্রাসীদেরকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে নিন্দা জ্ঞাপন করেন কোয়াড নেতৃত্ব। সরাসরি, পাকিস্তানের নাম না করে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ায় ইসলামাবাদের ভূমিকা নিয়ে সরব হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি সকল রাষ্ট্রের সকল সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার বিষয়েও কোয়াডের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।

তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। চীন, পাকিস্তান প্রকাশ্যে তালিবান সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েছে গোটা বিশ্বের। সে কারণেই কোয়াড সম্মেলনে আফগানিস্তান ইস্যুর উপর জোর দিয়েছেন মোদি-বাইডেনরা।

এদিকে, কৌশলগত বিষয় ছাড়াও করোনা মহামারী নিয়েও আলোচনা করেন কোয়াড অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো। জানা গিয়েছে, কোয়াড ভ্যাকসিন পার্টনারশিপ প্রকল্পের অন্তর্গত জনসন ও জনসনের ৮০ লক্ষ টিকা পাবে ভারত। অক্টোবরের শেষে ভারতে তৈরি জনসনের টিকার জোগান শুরু হয়ে যাবে।

একইসঙ্গে, কোয়াড দেশগুলোর মধ্যে অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, জাপান ও ভারতের মধ্যে যাতায়াত সহজ করার জন্য পারস্পরিকভাবে মান্যতা দিয়ে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট চালু করার কথাও বলেন মোদি।

পাশাপাশি, ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মীদের কথা মাথায় রেখে আমেরিকার H1B ভিসার প্রক্রিয়া সহজ করার আবেদন জানিয়েছেন মোদী। সব মিলিয়ে, কোয়াড বৈঠকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে আমেরিকার সঙ্গে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছে ভারত।

আলোচনাকালে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, “আমরা উদার ধারার গণতান্ত্রিক দেশগুলো স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল চাই। কারণ, মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশেই শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ে উঠতে পারে।”

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা বলেন, “এই বৈঠকের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে সংহতি শক্তিশালী হবে।” অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, “কোয়াডভুক্ত চার প্রধান গণতান্ত্রিক দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ইতিহাস রয়েছে। আমরা জানি কীভাবে কোনো কিছুর সমাধান করতে হয়। আর আমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত।”

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার ওপর জোর দেন। মোদী বলেন, “আমাদের কোয়াড জোট বিশ্বের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। পারস্পরিক সহযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক ও বিশ্ব শান্তির জন্য জরুরি।”

এদিন কোয়াড বৈঠকে নিজের বক্তব্যের সূচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, “২০০৪ সালে সুনামির সময়ে আমরা হাত মিলিয়ে কাজ করেছিলাম। পরে কোয়াডের সদস্য হিসেবে একসঙ্গে কোভিড মোকাবিলাও করেছি। কোয়াড ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে।”

প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, “একভাবে, আমাদের চতুর্দেশীয় জোট বৈশ্বিক মঙ্গলের শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আজ, যখন বিশ্ব কোভিড মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, কোয়াডের অধীনে আমরা আবার মানবতার কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখানে এসেছি।”

এসময়, প্রযুক্তিগত উতকর্ষ সাধন, ৫জি নেটওয়ার্ক স্থাপন, সর্বত্র সাইবার নিরাপত্তা বিকাশ সহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন মোদী। তাছাড়া, উত্তর কোরিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়েও আলোচনা হয় কোয়াডে। পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে জাতিসংঘ নীতিমালা মেনে চলার আহবানও জানায় জোটটি।

আসন্ন সময়ে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর করণ, কার্বন নিঃসরণ, কোপ-২৬ শীর্ষ সম্মেলন, জি-২০ শীর্ষ বৈঠক এবং বহুপাক্ষিক অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার শোনা যায় কোয়াড নেতৃত্বের মুখে। বৈশ্বিক যেকোনো সঙ্কট মোকাবেলায় ঐক্যের বার্তাই শোনান কোয়াড নেতৃত্ব।