বিশ্লেষক মহলের ধারণা, পাকিস্তান যদি যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মার্কিন সেনাদের জন্য নিজ ভূমিতে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়, তবে দু দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হবে।

আফগানিস্তান হতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকেই পাকিস্তানে সেনা ঘাঁটি গড়ার অনুমতি চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শুরু থেকেই এ দাবি নাকচ করে আসছে পাকিস্তান। গত মে মাসেও পাকিস্তান সিনেটে ভাষণ দেয়ার সময় পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কুরেশি বলেন, “ইমরান খান সরকারের আমলে পাকিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়া হবেনা।”



কুরেশির এই বক্তব্যের প্রায় এক মাস পর এইচবিও অ্যাক্সিওস চ্যানেলের জোনাথন সোয়ানকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উপরোক্ত কথার পুনরাবৃত্তি করেন ইমরান খান স্বয়ং। পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনা কিংবা ড্রোন ঘাঁটি স্থাপনের যেকোনো সম্ভাবনাকে সমূলে উড়িয়ে দেন এই ক্রিকেটার কাম রাজনেতা।



এখানে মনে রাখতে হবে, গত মে মাসের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি গড়তে সহায়তাকারী যেকোনো মধ্য এশীয় দেশের বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার কথা জানান দেয় আফগান তালেবান। কিন্তু এ ঘোষণার পরপরই আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।



সম্প্রতি আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে হামলায় কমপক্ষে ১৭৫ জন আফগান নাগরিক ও ১৩ জন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার এক দিন পর ড্রোন হামলা চালিয়ে আইএসের 'পরিকল্পনাকারীকে' হত্যার দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র।



এর প্রেক্ষিতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তালেবান জানায়, “আফগানিস্তানের পবিত্র আকাশসীমা ব্যবহার করে আক্রমণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই লঙ্ঘন যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।”



ভূ-রাজনৈতিক ঘটনার পরম্পরায় গত ২১ জুন ওয়াশিংটন পোস্টের এক লেখনীতে ইমরান খান বলেন, “আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা আমেরিকার সঙ্গে অংশীদার হতে প্রস্তুত। কিন্তু মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার না হলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব নয়। যদি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে নজরদারিতে ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেয়, তাহলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার্থে পাকিস্তানকে আবারও টার্গেট করা হবে।”



একদিকে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অবস্থানকালের মেয়াদ কমে আসছিলো। অন্যদিকে পাকিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি সরবরাহ করতে সম্মত ছিলো না। তবে আমরা যারপরনাই আশ্চর্য হই, যখন দেখলাম, আফগানিস্তান ত্যাগ করে মার্কিন সেনাদের একটি অংশ গত আগস্টে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেছে। পরদিন পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ বলেন, “মার্কিন সেনারা খুবই অল্প সময়ের জন্য পাকিস্তানে এসেছেন। শীঘ্রই তাঁরা ওয়াশিংটন রওনা হবেন।”



কিন্তু সবচেয়ে মজার এবং বিস্ময়ের ব্যাপার, আজ অবধি পাকিস্তানে মার্কিন সেনারা পাকিস্তান ভূখন্ডেই রয়ে গিয়েছেন। পাকিস্তানও এখন এ বিষয়ে অনেকটা ধরি মাছ, না ছুই পানি পন্থা অবলম্বন করছে। সম্প্রতি ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুরেশি বলেন, “আফগানিস্তানে মার্কিন ঘাঁটির বিষয়ে মন্ত্রীসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত ফাইনাল করা হবে।” তাই স্বভাবতই প্রশ উঠছে, বাইডেন প্রশাসনকে কী সূক্ষ্ম কোনো বার্তা দিতে চাইছে ইমরান সরকার? নাকি মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে পাকিস্তান?



খবর রয়েছে, ড্রোন ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুশ সীমান্ত সংলগ্ন অনান্য মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছে। যদি তাঁরা এমন একটি উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যায়, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা পাকিস্তানকে উপেক্ষা করার সুযোগ পাবে। তাজিকিস্তানের সঙ্গে ইতোমধ্যে তালেবানের যে দহরম মহরম শুরু হয়েছে, তাতে যেকোনো মুহূর্ত তাজিক প্রশাসন এই সুবিধা নিতে চাইবে। ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাবে পাকিস্তান। বিষয়টি ইসলামাবাদেরও অজানা নয়। তাই তারাও নিজেদের পূর্ব সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করতে আরম্ভ করেছে।



তাছাড়া, অতি সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে কাউন্টার টেররিজম, ওভারসাইট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি (এসিওএ) আইন প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। মূলত ২০০১ থেকে ২০২০ সাল অবধি তালেবানকে সমর্থন দেয়া গোষ্ঠী গুলোর ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে। সবাই জানে এমন একটি রিপোর্ট পেশ করা হলে খুবই অনুমানযোগ্য ভাবে পাকিস্তান ফেঁসে যাবে। সেক্ষেত্রে সুপ্রশস্থ হবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সম্ভাবনা। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের যে অর্থনীতি, তাতে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লে ইমরান সরকারের কফিনে শেষ পেরেক লাগানোর কাজ হয়ে যাবে। এর থেকে উত্তরণ ঘটানোর জন্যে হলেও পাকিস্তানকে যে করেই হোক যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতেই হবে।



সম্প্রতি পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢালাওভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন যে আমরা তালেবানদের সাহায্য করেছি। অথচ আমরা কেবলমাত্র তাদেরকে আলোচনার টেবিলে আসতে অনুরোধ করেছি এবং সহায়তা করেছি।”



এদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান গত সপ্তাহে তাঁর নির্ধারিত পাকিস্তান সফরের পূর্বে এক ভাষণে বলেন, “আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব চাই। আমরা আশা করি সব জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো পার্থক্য ছাড়াই ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিবে পাকিস্তান।”



ফলস্বরূপ পাকিস্তানের উপর পরোক্ষভাবে হলেও জঙ্গীবাদ সংশ্লিষ্টতা এবং তা অবশ্যই দমনের চাপ প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে আলোচনার অনুমতি দেননি। এটিও আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।



পাকিস্তান যেভাবে বিভিন্ন ঋণের বোঝা নিজ কাঁধে এনে ফেলেছে, সে অবস্থা থেকে উত্তরণ তাঁদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। এর মাঝে মার্কিন বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং গণমাধ্যম পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য কপটতা তুলে ধরে যেভাবে নিয়মিত শিরোনাম করছে, তাতে রীতিমতো অন্ধকার দেখছে ইমরান খানের সরকার।



এরই মাঝে পাকিস্তানের জন্য কাটা ঘায়ে নূনের ছিটা হয়ে এসেছে ভারত সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের উষ্ণ সম্পর্ক। দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সকল প্ল্যাটফর্মে ওয়াশিংটন ডিসির সঙ্গে সম্পর্ক ব্যাপক মাত্রায় গভীর করেছে নয়াদিল্লী। তাই স্বভাবতই পাকিস্তান আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ব্যাপক চাপের মধ্য দিয়ে সময় পাড় করছে।



এদিকে, তালেবানকে ক্ষমতায় আনতে যদিও পাকিস্তান ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু ইইউ, মার্কিন সরকার, বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম গুলোর নানামুখী অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তান। কাবুলে তালেবান সরকার ব্যর্থ হলে সে বোঝাও পাকিস্তানের ঘাড়ে এসেই পড়বে। স্বভাবতই মানুষের ঢল নামবে পাকিস্তান অভিমুখে। সে চাপ সামলাতেও নানাভাবে হেনস্তা হতে হবে ইসলামাবাদকে। চীন তখন কোনোভাবেই এই ব্যর্থতার দায়ভার বহন করবেনা, এটা মোটামুটি স্বীকৃত।



তাই সর্বোপরি বলা যেতে পারে, হয়তো মার্কিন সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ চাপ, কিংবা ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলা অথবা কূটনৈতিক চালের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার কাছে নতি স্বীকার করতে যাচ্ছে পাকিস্তান। যদি তাই হয়, তবে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গত তিন মাসে যে সমীকরণ কল্পনা করেছিলেন সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকগণ, সে বিশ্লেষণেও নানান পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী।



লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, কৌশলগত কূটনীতি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত লেখনী সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব অভিমত)