যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে বাঁধা দেয়, এমন সিস্টেমের প্রতি ভারতের বিদ্বেষ পরিবর্তিত হয়নি।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের উদ্যোগে বিশ্বের ১১০ টি দেশের সমন্বয়ে আগামী ০৯-১০ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্যাপক সাড়া জাগানো গণতন্ত্র সম্মেলন। মার্কিন মুল্লুকের দায়িত্ব নেয়ার পর এখনও অবধি নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে নিঃসন্দেহে এটি বাইডেনের সবচেয়ে পছন্দের আয়োজন হতে চলেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু, নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ট্রাম্পের সঙ্গে কুৎসিত বিবাদে জড়িয়ে বাইডেনের নিজ রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র বিপাকে পড়ে যায়।

বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অস্থিরতার কথা সকলেরই জানা। তখন অনেক বিশ্লেষকই দাবি করেছিলেন, পৃথিবীব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বিগত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হারানো ভাবমূর্তি ফেরানোর সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাইডেন। ফলত, এবারের গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলনকে ওয়াশিংটনের ভাবমূর্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা হিসেবেও অভিহিত করা যেতে পারে।

কিন্তু, অন্য সব বড় আয়োজনের মতোই এবারের আয়োজন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে তীব্রভাবে। শীর্ষ সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো দেশগুলো কোন মানদণ্ডের উপর নির্বাচন করা হয়েছে, অন্যদিকে যাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে, কেনোই বা তাঁদের বাদ দেয়া হলো, এসব নিয়ে রীতিমতো বিপাকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। তবে, গোটা ব্যাপারটিকেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সম্মেলনে আমন্ত্রিত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের উপস্থিতি নিয়ে স্বভাবতই কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সম্মেলনে ভারতের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি ছিলো সময়ের ব্যাপারে মাত্র। কিন্তু পাকিস্তানকে বেছে নিয়ে বাংলাদেশকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই বোধগম্য হতে পারেনা। বাদ পড়ার পর রাশিয়া ও চীনও ক্ষুদ্ধ্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে গোটা মার্কিন প্রক্রিয়ার। তাঁরা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোটা সম্মেলনের বিষয়টিকেই জাতিসংঘের ভূমিকাকে দুর্বল করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় কৌশলের একটি অংশ হিসাবে অভিহিত করেছে এবং মার্কিন স্যাটেলাইট মিত্রদের এক নতুন জোট হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

অন্যদিকে, চীনও একহাত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। চীনকে বাদ দিলেও আমন্ত্রণ পেয়েছে তাইওয়ান। যে কারণে ক্ষুদ্ধ হয়েছে বেইজিং। তাইওয়ানকে সম্মেলনে ডেকে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ভুল করেছে বলে জানিয়েছে চীন। সম্মেলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বলে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করছে বলেও অভিযোগ করেছে দেশটি।

শুধুমাত্র ভারতের দিক থেকে বিবেচনা করলেও এই সম্মেলন নিয়ে আশার পাশাপাশি আশঙ্কার বার্তা নেহায়েত কম নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত এক নিরপেক্ষ অভিনব পররাষ্ট্রনীতির উপর ভর দিয়ে এগোচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যেও ভারত সমানতালে নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে সার্বজনীন করতে সক্ষম হয়েছিলো। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেও ভারত অন্যতম বড় নাম। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে মস্কোকে নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছে, সেখানে ওয়াশিংটন ঘেষা কূটনীতি কতটা ফলপ্রসূ হবে ভারতের জন্য, সে বিষয়েও ভাবতে হবে।

ইতোপূর্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় সহ বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষাপটে ভারতকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। ওয়াশিংটন পন্থী কর্মকান্ডে বোদ্ধামহলের ধারণা, ভারত নিজেদের পক্ষে একটি নির্ভরযোগ্য এবং সহায়ক সুপার পাওয়ার হারাতে চলেছে। আবার অনেকেই বলছেন, যেহেতু ভারত জোট নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, তাই ভারতের অধিকার রয়েছে যেকোনো সম্মেলন বা বৈঠকে বসার।

এদিকে, ভারতের জন্যে আরেকটি চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিশ্বমঞ্চে চীনের ক্রমাগত উত্থান। মার্কিন প্রশাসন রাশিয়া ও চীনকে একযোগে কোনঠাসা করায় স্বভাবতই তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। এমন অবস্থায় যদি ভারত রাশিয়ার সমর্থন হারায়, তবে সীমান্তে চীনের শক্তি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। তাই চীনকে ঠেকানোর জন্য হলেও ভারতের অবশ্যই উচিত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সর্বাবস্থায় সমুন্নত রাখা।

সম্প্রতি শেষ হওয়া এসসিও বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে। গোটা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সংবেদনশীলতা এবং পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। সবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার যে ভারতীয় ঐতিহ্য, নিজ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আদতে এটাই হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সবচেয়ে গভীরে অবস্থান করছে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপটকেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বুলি আওড়াচ্ছে। তবে এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগলিক রাজনৈতিক সুবিধার কথা আর আড়ালে নেই। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের অবস্থান মজবুত করতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই এঁকে অন্যের কাছাকাছি এসেছে। তাছাড়া, আফগানিস্তান থেকে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে বিদায় নেয়া মার্কিন প্রশাসনের কাছে ভারত বর্তমানে সেফ হোমের মতো। ভারতও মৌলবাদী শক্তির হাত থেকে নিজের ভূখন্ডকে রক্ষা করতে মার্কিন প্রশাসনকে মিত্র করে রেখেছে।

তবে, উদ্বেগের বিষয় এই যে, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র শীতল যুদ্ধের সময় ভারত সাম্যবস্থা বিরাজমান রাখতে পারলেও চীন-যুক্তরাষ্ট্র শীতল যুদ্ধ চলাকালে ভারত এই অবস্থায় স্থির থাকতে পারছে না। তাই স্বভাবতই ভারতের জোট নিরপেক্ষতা হুমকির সম্মুখীন।

তবে রুশ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব বজায় রাখতে সম্প্রতি ভারত এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার কথা এগিয়ে নিয়েছে। এতে একটা সামগ্রিক ব্যালেন্স তৈরীর চেষ্টা নয়াদিল্লী করছে।

আবার এসব দর কষাকষি অনুষ্ঠানের ফলে বাণিজ্যিকভাবে ভারতের সক্ষমতা বাড়ছে বৈ কমছে না। সম্প্রতি মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাইয়ের সফরকালে নতুন করে শুরু হয়েছে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য ফোরামের বৈঠক। রাশিয়ার সাথে করোনা টিকার প্রায় ৮৫ কোটি ডোজ উৎপন্ন করছে ভারত। তেল আমদানিতে ভারতের উপর ছাড় বাড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়া, কোয়াড গঠনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সাথেও ঘনিষ্ঠতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতের। আবার ব্রিকসের সভাপতিত্ব করার দরুণ চীন ও রাশিয়ার সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। বেসামরিক পারমাণবিক, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, বাণিজ্য, হীরা এবং হাইড্রোকার্বন খাতে ভারত এসব বড় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। ফলে মহামারী উত্তর সময়ে অর্থনীতির চাকাও ঘুরতে আরম্ভ করেছে।

তবে রাশিয়ার সাথে যে ভারতের সম্পর্ক এখনও মজবুত রয়েছে, এজন্যে ভারতীয় নেতৃত্বের চেয়ে কৃতিত্ব দেশটির রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বেশি। সকল হিসেব নিকেশ ভুলে তিনি ভারতের সঙ্গে সমৃদ্ধ সম্পর্ক তৈরি ও ধরে রাখায় মন দিয়েছেন। সম্প্রতি ভারতের ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে ভারতের প্রশংসা করেছেন পুতিন। আগামী ০৬ ডিসেম্বর ২১ তম শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও মোদীর সঙ্গে মিলিত হবেন পুতিন। এজন্যে ভারত সফরের কথা রয়েছে তাঁর। তাছাড়া, ২+২ ফরম্যাটেও মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে ভারত ও রাশিয়া। একই বার্তা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও।

তাই বলা যায়, ভারত সময়ের সবচেয়ে জটিল পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারতের মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে যেমন ভারতের বাস্তবতা বুঝতে হবে, তেমনই ভারতীয় নেতৃত্বকেও সব পদক্ষেপ নিতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা রাশিয়া তখনই নয়াদিল্লীকে সম্মান করবে, যখন ভারত নিজের নৈতিক অবস্থানে শক্তিশালী পর্যায়ে থাকবে। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক