ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ৩০ জানুয়ারী থেকে ০১ ফেব্রুয়ারী অবধি তিনদিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন।
চীনের সাথে মোকাবিলা করার জন্যে ভারত ও আমেরিকা এবার উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষার উদ্যোগ শুরু করেছে। মূলত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে টক্কর দিতে এবং অস্ত্রের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে আমেরিকা ও ভারত উন্নত প্রতিরক্ষা এবং কম্পিউটিং প্রযুক্তির পরিকল্পনা করছে বলে জানা গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, আমেরিকা বহুবার বলেছে অস্ত্রের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতার কারণে ভারত রাশিয়ার কাছাকাছি থাকলেও আমেরিকাও এবার ভারতকে আধুনিক প্রযুক্তি প্রদানে সহযোগিতা করবে।

এদিকে, এই প্রতিরক্ষা উদ্যোগ জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির জেট ইঞ্জিনের যৌথ উৎপাদনকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে, আমেরিকা চায় যে ভারত চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে গিয়ে অস্ত্রের জন্য যেন শুধুমাত্র রাশিয়ার ওপর নির্ভর না করে। এমতাবস্থায়, এই প্রতিরক্ষা উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে “ইউএস-ইন্ডিয়া ইনিশিয়েটিভ অন ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজিস।” সেনাবাহিনী এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করার বিস্তৃত এজেন্ডা নিয়ে, ভারত এবং আমেরিকা গত মঙ্গলবার এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।

মূলত, “ইনিশিয়েটিভ অন ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজিস”- হল চীনকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে মিত্র দেশগুলির সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রসঙ্গে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের ফ্রেমওয়ার্ক শুধু রাশিয়া বা চীন দ্বারা তৈরি করা হবে না। কারণ চীনের আগ্রাসী সামরিক কৌশল এবং অর্থনৈতিক শক্তি ভারতের রাজধানী দিল্লি ছাড়াও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাজধানীতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।”

১। চীনকে টক্কর দিতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি: উল্লেখ্য যে, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে বৈঠক করেন। ওই সময়ে এই দুই দেশ যৌথ অস্ত্র উৎপাদনের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ৫জি ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক এবং সেমিকন্ডাক্টর সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে।

এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২২ সালের মে মাসে জাপানের রাজধানী টোকিওতে তাঁদের বৈঠকের সময়ে এই সংক্রান্ত চুক্তিতে সম্মত হন। সুলিভান বলেন, “এটি সত্যিই উভয় নেতারই একটি কৌশলগত বাজি। আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া তৈরি করা উভয় দেশের কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত স্বার্থ পরিবেশন করবে।”

২। কৌশলগতভাবে বড় পদক্ষেপ, আমেরিকা: সুলিভানের মতে, এই উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মিত্র এবং অংশীদার দেশগুলির সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কৌশলের অংশ। অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের সাথে ওউকাস সাবমেরিন চুক্তি এবং কোয়াড দেশগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিও এই কৌশলের অংশ।”

সুলিভান আরও বলেছেন যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য এটি কৌশলগতভাবে একটি বড় পদক্ষেপ। এই প্রসঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সাথে কথা বলার আরেক মার্কিন আধিকারিক বলেছেন, “প্রযুক্তিগত এই উদ্যোগের সাথে আরও বেশ কয়েকটি চুক্তি থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে, ২০২৩ সালটি সম্ভবত মার্কিন-ভারত কূটনীতির ক্ষেত্রে সেরা বছর হবে। কারণ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।”

এছাড়াও, ওই আধিকারিক আরও বলেন, চীনের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে বিশেষ করে ২০২০ সালে গালভান উপত্যকায় গুরুতর সীমান্ত সংঘর্ষের পরে ভারত আমেরিকার কাছাকাছি এসেছে। ভারত হয়তো এটা প্রচার করছে না।”

৩। প্রাথমিকভাবে জেট ইঞ্জিন এবং আর্টিলারি সিস্টেমগুলোতে লক্ষ্য রয়েছে: ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসাথে অস্ত্র তৈরির প্রাথমিক প্রচেষ্টায় জেট ইঞ্জিন, আর্টিলারি সিস্টেম এবং পদাতিক যানের উপর ফোকাস করবে। সুলিভানের মতে, জেনারেল ইলেকট্রিক উভয় দেশের সাথে যৌথভাবে জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য মার্কিন সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছে।

এই প্রসঙ্গে মার্কিন ও ভারতীয় কোম্পানির সিইওরা এবং সিনিয়র নেতারা সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বের প্রচারের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠক করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে। যেখানে মাইক্রোন, লকহিড মার্টিন এবং অ্যাপ্লায়েড মেটিরিয়ালসের মতো আমেরিকান কোম্পানি এই বৈঠকে অংশ নেয়। অন্যদিকে ভারত থেকে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস এবং আর্সেলর মিত্তল অংশ নিয়েছিল।

৪। কেন এই চুক্তি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তার দেশীয় প্রযুক্তির সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় চিপ শিল্প ছাড়াও, ভারত উদীয়মান সেক্টরগুলোকেও উন্নত করতে চায়। ভারতীয় আধিকারিকরা চান অ্যাপল, স্যামসাং এবং অন্যান্য বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করুক।

৫। রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা: এদিকে, ভারত যদি জেনারেল ইলেকট্রিককে যৌথভাবে জেট ইঞ্জিন তৈরির অনুমতি দেয়, তাহলে এটি হবে সামরিক অস্ত্রের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার আমেরিকার প্রচেষ্টা কূটনৈতিকভাবে চাঙ্গা হবে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ভারত তার ফাইটার বিমানের বহরে রাশিয়ান, ইউরোপীয় এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি জেট ব্যবহার করে।

যদিও, মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলিভান স্বীকার করেছেন যে, ভারত ও রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসার কথা বিবেচনা করে ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি করা ঝুঁকিমুক্ত নয়। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, এই চুক্তি ইউক্রেনের যুদ্ধ বা রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ককে প্রভাবিত করার জন্য করা হয়নি। তাঁর মতে “আমি আদৌ বলছি না যে রাশিয়ান অস্ত্রের পরিবর্তে ভারতকে অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহের সুবিধা দেওয়া একটি অপ্রাসঙ্গিক ধারণা। এটা একেবারেই ওই রকম না।”

৬। চীনের নেতিবাচক আচরণ বিশ্বের জন্য হুমকি: সুলিভান বলেন, এই প্রতিরক্ষা উদ্যোগ ভারতের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ দেয় না। তবে চীনের নেতিবাচক আচরণ বিশ্বের দেশগুলিকে প্রভাবিত করছে। তিনি বলেন, “চীনের অর্থনৈতিক পরীক্ষা, সামরিক আগ্রাসন, ভবিষ্যতের শিল্পগুলিতে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি ভবিষ্যতের সরবরাহ চেইনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা ভারতের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।”

তিনি বলেন, হোয়াইট হাউস ভারত থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রতিভাকে আকৃষ্ট করতে মার্কিন কংগ্রেসের সাথে কাজ করবে। ভারতীয় প্রতিভা আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমেরিকা দেশীয় চিপ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক