সহস্রাব্দ প্রাচীন ভারত-নেপাল সম্পর্ক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল আঙ্গিকেই দারুণ ঐতিহ্যবাহী।
২০০৮ সালে চিন সফরের পরে প্রচণ্ড নামে পরিচিত পুষ্প কমল দহলই নেপালের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম, যিনি তাঁর প্রথম সফরের গন্তব্য হিসাবে ভারতকে বেছে নেননি। সেই ঘটনা থেকে এগিয়ে ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রচণ্ড ভারতকে শুধু মাত্র তাঁর প্রথম গন্তব্য হিসেবেই বেছে নিলেন না, বরং একই সঙ্গে তাঁর চার দিনের সফরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সফরটিকে একটি ‘বিরল সাফল্য’ বলে অভিহিত করলেন। সাম্প্রতিক সফরটি দর্শায় যে, ভারত এবং নেপাল তাদের সম্পর্কের কঠিন অবস্থা অতিক্রম করেছে এবং এই ‘সফল’ সম্পর্কটিকে ‘হিমালয়ের উচ্চতা’য় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সফরের চার দিনে উভয় দেশই ভিন্নতার বদলে অভিন্নতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি প্রকল্প এবং ছ’টি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেন। জলবিদ্যুৎ, সংযোগ ব্যবস্থা এবং জনগণের মধ্যে সংযোগই এই ফলপ্রসূ সম্পৃক্ততার কেন্দ্রে জায়গা করে নেয়।

আলোচ্যসূচির শীর্ষে ছিল জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত সহযোগিতা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত এই লাভজনক অংশীদারিত্বকে ত্বরান্বিত করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ভারত নেপালের জলবিদ্যুৎ ক্রয় শুরু করে এবং ৪৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানির অনুমতি দেয়। এর ফল স্বরূপ, শুধু মাত্র ২০২২ সালেই জলবিদ্যুৎ থেকে নেপালের মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ বিলিয়ন। এই গতিশীলতার উপর ভর করে ভারত এবং নেপাল বর্তমানে আগামী ১০ বছরের জন্য জলবিদ্যুৎ রফতানির পরিমাণকে ১০,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে। তারা অরুণ এবং কর্নালি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিকাশের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সংস্থাগুলির জন্য নতুন সমঝোতাপত্র বা মউ স্বাক্ষর করেছে এবং পঞ্চেশ্বর বহুমুখী প্রকল্পের জন্য বিশদ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজে সম্মত হয়েছে। সর্বোপরি ভারত বাংলাদেশে নেপালের জলবিদ্যুৎ রফতানির কাজ সহজতর করে তোলার বিষয়ে রাজি হয়েছে।

সংযোগ, বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে সম্পৃক্ততা এই সফরে অগ্রাধিকার লাভ করে। উভয় দেশ একটি আন্তঃসীমান্ত পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন, আন্তঃসীমান্ত অর্থ প্রদান, চেক পোস্টগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদেশি পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সহযোগিতা স্থাপনের জন্য সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে। তারা ট্রানজিট চুক্তিরও পুনর্নবীকরণ করে, সমন্বিত চেকপোস্টের উদ্বোধন করে এবং ভারত থেকে নেপাল পর্যন্ত একটি কার্গো ট্রেন চলাচলের সূচনা করে।

সমগ্র সফর জুড়ে দুই নেতাই বিতর্কিত এবং সংবেদনশীল সমস্যাগুলির সমাধানের চেষ্টা করার পরিবর্তে পারস্পরিক ভাবে অভিন্নতার ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। উভয় পক্ষ সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে সম্মত হলেও এ বিষয়ে তেমন কোনও আলোচনা হয়নি। ভারতের প্রতিবেশ নীতি, নেপালের অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ এবং ভূ-রাজনীতির কারণে পারস্পরিক ভাবে লাভজনক ক্ষেত্রগুলির উপর সুনির্দিষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে নেপাল অবরোধের পরবর্তী সময়ে ভারত মনোভাব ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করেছে এবং নেপালের অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। তার নেবারহুড ফার্স্ট বা প্রতিবেশ প্রথম নীতিতে অর্থনৈতিক সমন্বিতকরণ ও সংযোগের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের স্বার্থ, অর্থনৈতিক চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলির কাছ থেকে ভারতের বিদেশনীতির ক্রমবর্ধমান সমালোচনা সত্ত্বেও এমনটা করা সম্ভব হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ দিক থেকে নেপাল রাজনৈতিক ভাবে অস্থিতিশীল। পার্লামেন্টে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব এবং ভুটানি উদ্বাস্তু কেলেঙ্কারির সাম্প্রতিক উন্মোচন প্রচণ্ডের ভঙ্গুর জোটকে তটস্থ করে রেখেছে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভারতের সঙ্গে নেপালের প্রধান সমস্যাগুলির সমাধানকে কেন্দ্র করে একটি নির্দলীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। এমনকি প্রচণ্ডও পারস্পরিক ভাবে লাভজনক ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করেছেন কারণ বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা তাঁদের পক্ষপাতমূলক নীতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে সমালোচনার সূত্রপাত করবে।

নেপালের অর্থনীতিও খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। দেশটি খাদ্য ও জ্বালানি মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক ভাণ্ডারের সম্মুখীন হচ্ছে। কাঠমান্ডু ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস সংক্রান্ত মন্দার সম্মুখীন। বর্তমানে নেপাল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দ্বারা প্রদত্ত একটি বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা থেকেও সহায়তা পেতে আগ্রহী। এর ফলে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার বজায় রাখা, মূলধন বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক ঘাটতি হ্রাস অবিলম্বে মনোযোগ দাবি করে, যেখানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সমন্বিতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক