প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গায়ানা সফর ভারতের সঙ্গে গায়ানা ও ক্যারীবীয়দের সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্যভাবে মজবুত করেছে।
অশোক সজ্জনহার: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৩ দিনের ঐতিহাসিক গায়ানা সফর ছিল কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর, যা ৫৬ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে ইন্দিরা গান্ধী গায়ানা সফর করেছিলেন সর্বশেষ। এই দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সফরের পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারত-ক্যারিকম (ক্যারিবীয়ান সম্প্রদায়) গোষ্ঠীর দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনের সহ-সভাপতিত্ব করেন। প্রথম সম্মেলনটি ৫ বছর আগে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ভারত-ক্যারিকম সম্পর্কের উন্নতি
ক্যারিকম একটি আন্তঃসরকারীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা, যা ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র এবং ৫টি সহযোগী সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত। এটি আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং আটলান্টিক মহাসাগরের দেশগুলো নিয়ে গঠিত। এর মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক সংহতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি, সংহতির সুফল সমানভাবে বণ্টন এবং পররাষ্ট্রনীতি সমন্বয়। ১৯৭৩ সালে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলো এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করে। এর সদর দপ্তর গায়ানার জর্জটাউনে অবস্থিত।

ক্যারিকম বর্তমানে স্বাধীন ইংরেজিভাষী দ্বীপ দেশসমূহ, বেলিজ, গায়ানা, মন্টসেরাট এবং সুরিনামসহ অন্যান্য ব্রিটিশ ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং বারমুডাকে সহযোগী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি গ্রেনাডার প্রধানমন্ত্রী ডিকন মিচেল, যিনি বর্তমানে ক্যারিকমের চেয়ারম্যান, তার সঙ্গে দ্বিতীয় ভারত-ক্যারিকম শীর্ষ সম্মেলনের সহ-সভাপতিত্ব করেন।

এই সম্মেলনে ১১টি সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান উপস্থিত ছিলেন। দেশগুলো হলো: অ্যান্টিগা ও বারবুডা, বাহামা, বার্বাডোস, ডমিনিকা, গায়ানা, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস, সুরিনাম, এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো। বেলিজ, জামাইকা এবং সেন্ট কিটস ও নেভিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও এতে অংশ নেন।

ক্যারিকমের অগ্রাধিকার বিষয়গুলো তুলে ধরা
প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্যারিকম শব্দের প্রতিটি বর্ণকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে সাতটি খাতের উন্নয়নের প্রস্তাব দেন। এগুলো হলো:

সি: দক্ষতা উন্নয়ন (Capacity building)
এ: কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা (Agriculture and food security)
আর: নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন (Renewable energy and climate change)
আই: উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য (Innovation, technology, and trade)
সি: ক্রিকেট ও সংস্কৃতি (Cricket and culture)
ও: সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা (Ocean economy and maritime security)
এম: ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা (Medicine and health care)

‘এই সাতটি স্তম্ভের মধ্যে একটি বিষয় অভিন্ন – এগুলো আপনাদের অগ্রাধিকার ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি আমাদের সহযোগিতার মূলনীতি,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। দক্ষতা উন্নয়নে, আগামী পাঁচ বছরে ক্যারিকম দেশগুলোর জন্য ১,০০০ নতুন আইটিইসি প্রশিক্ষণ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেন। ক্যারিকম দেশগুলো এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলোর জন্য অত্যন্ত প্রশংসা করেছে।

খাদ্য নিরাপত্তায়, ভারত ড্রোন ব্যবহার, ডিজিটাল কৃষি, মাটি পরীক্ষা এবং সাগরের শেওলা থেকে সার তৈরি করার পদ্ধতির প্রস্তাব দেয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে, ভারত আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্সের অভিজ্ঞতা, গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্সের সদস্যপদ এবং ‘লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট’ উদ্যোগের প্রস্তাব দেয়। ভারত তার ডিজিটাল জনপরিকাঠামো শেয়ার করার, ডিজিলকার ব্যবহারের এবং ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।

কোভিড-১৯ মহামারির সময় ভারতের সহায়তা
ক্যারিকম নেতারা বিশেষভাবে প্রশংসা করেছেন যে, কোভিড মহামারির চরম সময়ে ভারত তাদের টিকা ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ভারত বিস্তারবাদে বিশ্বাস করে না এবং অন্য দেশের সম্পদ লোভ করে না। তিনি ভারতকে ‘বিশ্ববন্ধু’ এবং গ্লোবাল সাউথের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন।

গায়ানার জিডিপি বৃদ্ধি
২০১৫ সালে গায়ানায় তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুত আবিষ্কৃত হওয়ায় দেশটি বিশ্বে জ্বালানি উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত গায়ানিজদের অবদান
গায়ানার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এদের পূর্বপুরুষরা ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা আখের বাগানে কাজ করতে গায়ানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আজ গায়ানার রাষ্ট্রপতি মো. ইরফান আলীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা রয়েছেন।

লেখক: অনন্ত আস্পেন সেন্টারের ডিস্টিংগুইশড ফেলো এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত; ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করেছেন। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক